সাজনার পুষ্টিগুণ উপকারিতা ও অপকারিতা
আরো পড়ুনঃ শসার পুস্টিগুণ উপকারিতা ও অপকারিতা
সাজনা বা মারিঙ্গা অত্যান্ত পুষ্টিকর একটি উদ্ভিদ। সাজনা যদিও একটি মৌসুমি সবজি। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে এটি প্রায় সারা বছর পাওয়া যায়। তাছাড়া, সাজনা প্রায় সকলের একটি পরিচিত এবং অত্যান্ত জনপ্রিয় একটি খাবার।
তবে, আমরা অনেকেই সাজনার পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে জানিনা। তাছড়া, সাজনার কিন্তু উপকারিতার পাশাপাশি কিছু অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। আর আমরা আজকের আর্টিকেলে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো, সাজনা সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ কিছু তথ্য। চলুন দেখি-
সাজনায় থাকা বিভিন্ন পুষ্টিগুণ
সাজনা বা মারিঙ্গা এমনি উদ্ভিদ, যার ফল, ফুল, পাতা, ডাটা এমনকি এর বীজ সবই খাওয়া যায় এবং বিভিন্ন পুস্টিগুণে ভরপুর থাকে। নিম্নে সাজনায় থাকা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পুষ্টিগুণ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
- প্রোটিন- সাজনার ডাল, পাতায় পাওয়া যায় প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন।
- পটাশিয়াম- এতে পাওয়া যায় কলার থেকেও উচ্চ মাত্রার পটাশিয়াম।
- ভিটামিন "এ"- সাজনায় রয়েছে গাজরের মতো উচ্চ মাত্রার ভিটামিন "এ"।
- ভিটামিন "সি"- সাজনায় রয়েছে কমলার চেয়ে অনেক বেশি ভিটামিন "সি"।
- ক্যালসিয়াম- সাজনায় পাওয়া যায় দুধের তুলনায় অনেকটা বেশি ক্যালসিয়াম।
- আয়রন- সাজনায় যে আয়রন পাওয়া যায়, তা রক্ত স্বল্পতা দূর করতে সাহায্য করে।
- অ্যান্টি- অক্সিডেন্ট- এতে রয়েছে প্রচুর অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান।
সাজনার উপকারিতা সমুহ
** রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা- সাজনা একটি অনেক পুষ্টিকর উদ্ভিদ, যা মানুষের শরীরের বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। কারণ, এতে পাওয়া যায়, ভিটামিন "এ, সি", অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, আয়রন ও ক্যালসিয়াম, যা শক্তিশালী করে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে।
সাজনা অনেক সাহায্য করে শরীরের টক্সিন দূর করতে ও সাহায্য করে সংক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করতে। এতে থাকা অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি গুণাবলী মানুষের শরীরের বিভিন্ন প্রদাহ জনিত রোগ থেকে রক্ষা করে।
তাছাড়াও, শরীরকে শক্তিশালী করে সাজনা নিয়মিত ব্যবহারের ফলে এবং ঠাণ্ডালাগা, জ্বর, উচ্চ রক্তচাপ এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই, প্রাক্রিতিকভাবে শরীরকে সুস্থ্য রাখার জন্য সাজনা হতে পারে একটি কার্যকরী উপাদান।
** চোখের উপকারে- সাজনা চোখের জন্য অত্যান্ত উপকারি। কারণ, এতে পাওয়া যায়, ভিটামিন "এ", যা সাহায্য করে দৃষ্টি শক্তি উন্নত করতে, বিশেষ করে রাতকানা রোধে অনেক কার্যকরী। এতে থাকা অ্যান্টি অক্সিডেন্ট এবং বিটা ক্যারোটিন চোখের কোষ রক্ষা এবং শুষ্কতা কমায়।
সাজনা চোখের প্রদাহ ও সাহায্য করে সংক্রামণ রোধে। সাজনা পাতা বা এর রস নিয়মিত গ্রহনে দূর হয় চোখের ক্লান্তি এবং স্বাভাবিক রাখে দৃষ্টিশক্তি।
তাছাড়াও, সাজনার তেল ও বীজ চোখের জন্য অনেক উপকারি। এটি চোখের চারপাশের ত্বক উজ্জ্বল করে তোলে। তাই দৃষ্টিশক্তি ভালো রাখার জন্য সাজনা পাতা অত্যান্ত কার্যকর।
** দূর করে রক্তস্বল্পতা- সাজনা এমন একটি প্রাকৃতিক উপাদান, যা চোখের জন্য অনেক কার্যকরী। কারণ, এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন সি, আয়রণ ও ফোলেট থাকে, যা সাহায্য করে হিমোগ্লোবিন বৃদ্ধিতে। আয়রন সাহায্য করে অক্সিজেন পরিবহণে এবং আয়রণের শোষণ বাড়ায় ভিটামিন "সি"।
সাজনা পাতা বা এর গুড়ো নিয়মিতভাবে সেবনে রক্ত সল্পতা কমে এবং চাঙ্গা থাকে শরীর। আবার এতে থাকা অ্যামিনো অ্যাসিড এবং অ্যান্টি অক্সিডেন্ট বৃদ্ধি করে রক্তের উৎপাদন। বিশেষ করে অপুষ্টিতে ভোগা এবং গর্ভবতী মা- বোনদের জন্য এটি অনেক উপকারি।
তাই, সাজনা প্রতিদিনের নিয়মিত খাদ্যতালিকায় যুক্ত করলে প্রতিরোধ করা সম্ভব রক্ত স্বল্পতা। তাছাড়া, এটি অনেক সাশ্রয়ী এবং সহজলোভ্য হওয়ায় যে কেউ ব্যবহার করতে পারে।
** হজমশক্তিতে সহায়ক- সাজনা দারুন কার্যকর হজমশক্তি উন্নত করতে। এর ফাইবার ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপাদান সহজ করে হজম প্রক্রিয়াকে এবং উন্নত করে অন্ত্রের স্বাস্থ্যকে।
সাজনা পাতায় রয়েছে পলিফেলন এবং এনজাইম, যা সাহায্য করে খাবার দ্রুত হজমে, ফলে গ্যাস, বদহজম এবং দূর করে কোষ্ঠকাঠিন্য। এটি অন্ত্রের উপকারি ব্যাকটেরিয়াকে বৃদ্ধি করে, ফলে সুস্থ্য থাকে পরিপাকতন্ত্র।
তাছাড়া, সাজনার প্রদাহনাশক গুণ, আরাম দেয় অন্ত্রের প্রদাহকে কমিয়ে। যদি সাজনা পাতা বা এর গুড়ো নিয়মিত সেবন করেন, তাহলে মজবুদ হয় পরিপাক তন্ত্র, সক্রিয় থাকে বিপাকক্রিয়া এবং দূর হয় শরীরের টক্সিন। তাই হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে সাজনা প্রাকৃতিক একটি সমাধান।
** দাত ও হাড়ের জন্য- দাত ও হাড়ের জন্য সাজনা সুপারফুট হিসাবে অধিক পরিচিত। কারণ, এতে রয়েছে, উচ্চ মাত্রার ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ফসফরাস, যা সাহায্য করে হাড়ের ঘনত্ব বাড়াতে ও প্রতিরোধ করে অস্টিওপরোসিস।
আরো পড়ুনঃ সুস্থ জীবনযাত্রার গোপন রহস্য | সুস্বাস্থ্য ও সঠিক লাইফস্টাইল
তাছাড়া, এতে থাকা অ্যান্টি ইনপফ্লেমেটরি উপাদান হাড়ের ব্যাথা এবং সন্ধির প্রদাহ কমায়। আবার এর পাতা ও ফল দাঁতের জন্য অনেক উপকারি, কারণ এতে রয়েছে অ্যান্টি ব্যাকটেরিয়াল ও ভিটামিন "সি' এর মতো উপাদান, যা দাঁতের ক্ষয় প্রতিরোধ এবং মাড়ির সংক্রামণ দূর করে।
তাই, নিয়মিত সাজনা খেলে মজবুত হয় হাড় এবং ভালো থাকে দাঁতের স্বাস্থ্য, বিশেষ করে শিশু, গর্ভবতী মা- বোন এবং বৃদ্ধদের জন্য অনেক উপকারি।
** কোলেস্টেরল কমায়- কোলেস্টেরল কমাতে সাহায্য করে সাজনা, বিশেষ করে এর বীজ এবং পাতায় থাকা উপকারি উপাদানের কারণে। এতে রয়েছে, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, ফাইটোস্টেরল এবং পলিফেনল সাহায্য করে কলেস্টেরলের স্থর নিয়ন্ত্রণে।
গবেষণায় উঠে এসেছে যে, সাজনার LDL রক্তের কোলেস্টেরল কমায় এবং HDL উপকারি কোলেস্টেরল বাড়াতে সাহায্য করে, ফলে কমে যায় হৃদরোগের ঝুকি। যেহেতু সাজনা সুরক্ষা প্রদান করে রক্তনালীর স্বাস্থ্য উন্নত করতে এবং নিয়ন্ত্রণে রাখে উচ্চ রক্তচাপ।
তাই , কোলেস্টেরল কমাতে এবং সঠিক হার বজায় রাখতে নিয়মিত সাজনা খাওয়া জরুরি।
** ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করে- ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাজনা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। কারণ, এর ফুল, ফল এবং পাতা সবই অ্যান্টি অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ডায়াবেটিস উপাদানে সমৃদ্ধ থাকে। এতে থাকা কেরসেটিন ও ক্লোরোজেনিক অ্যাসিড সাহায্য করে রক্তের শর্করা কমাতে।
একটি গবেষণায় জানা গেছে, ইনসুলিন সংবেদনশীলতা বাড়িয়ে রক্তের গ্লুকোজ নিয়ন্ত্রণে রাখে সাজনা পাতা। তাছাড়া, সাজনায় বেশি পরিমাণে ফাইবার থাকায় হজম প্রক্রিয়াকে ধীরে করে এবং রক্তে শর্করা হঠাত বৃদ্ধি প্রতিরোধ করে।
তাই, সাজনা পাতা বা গুড়া নিয়মিত সেবন করলে টাইপ ২ ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য অনেক উপকার হতে পারে। তবে, নিরাপত্তার জন্য বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে সেবন করা উচিৎ।
** ক্যান্সার প্রতরোধকারী- সাজনা একটি পুষ্টিকর উদ্ভিদ, যা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে ক্যানসার প্রতিরোধে। সাজনায় রয়েছে, অ্যান্টি অক্সিডেন্ট, অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি এবং ফাইটোকেমিক্যাল গুণ, যা বাধা প্রদান করে ক্যান্সারের কোষগুলোর বৃদ্ধিতে এবং স্বাস্থ্যকর রাখে শরীর।
সাজনা পাতায় রয়েছে, ভিটামিন "সি এবং এ", জিঙ্ক, বিটা ক্যারোটিন ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান, যা মানুষের শরীরের বিভিন্ন ধরণের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে এবং কমিয়ে দেয় ক্যানসারের ঝুকি।
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে যে, ক্যানসারের বিভিন্ন ধরণের কোষের বৃদ্ধি কমাতে সাজনা সাহায্য করে, বিশেষ করে এটি কার্যকর লিভার, স্তন এবং গ্যাস্টিক ক্যানসারের ক্ষেত্রে অধিক। তবে, এটি সহায়ক খাদ্য হিসাবে চিকিৎসার পরিবর্তে ব্যবহার করা উচিৎ।
** ত্বক ও চুলের জন্য- ত্বক ও চুলের যত্নে সাজনা একটি অত্যান্ত কার্যকরী একটি প্রাকৃতিক উপাদান। সাজনা ত্বককে করে ময়েশ্চারাইজ এবং উজ্জল। কারণ, এতে থাকা ভিটামিন "সি" ত্বকের কোলাজেন বৃদ্ধি করে মেছতা এবং বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে।
তাছাড়া, চুলের জন্যেও অনেক উপকারি সাজনা, কারণ এটি চুলের বৃদ্ধিতে সাহায্য করে এবং দূর করে চুলের শুস্কতা। সাজনায় থাকা অ্যান্টি ইনফ্ল্যামেটরি উপাদান ত্বকের প্রদাহ কমায় এবং চুলকে করে তোলে স্বাস্থ্য উজ্জল।
আবার, এটি প্রাকৃতিক উপায়ে সৃষ্টি করে মাথার ত্বকে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ, যার ফলে চুল পড়া অনেক কমে যায়। তাই ত্বক ও চুলের উপকারিতায় সাজনা অন্যতম একটি কার্যকর প্রাকৃতিক উপাদান হিসাবে কাজ করে।
সাজনার অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
সকল উপকারিতার পিছনে কিছু অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া থাকাটাই স্বাভাবিক। সেক্ষেত্রে সাজনারও কিছু অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া রয়েছে। যদিও, এর পরিমাণ উপকারিতার তুলনায় অনেক কম। নিম্নে এর অপকারিতা সম্পর্কে আলোচনা করা হলো-
- অধিক পরিমাণে সাজনা খেলে অস্বস্তি বা গ্যাসের সমস্যা হতে পারে।
- নিম্ন রক্তচাপের রোগীদের ক্ষেত্রে রক্তচাপ আরো কমিয়ে সমস্যা দেখে দিতে পারে।
- সাজনা অধিক পরিমাণে খাওয়ার কারণে, ডায়রিয়াসহ পেটের অন্যান্য সমস্যা দেখা দিতে পারে।
- কিছু ওষুধের সঙ্গে এর কার্যকরীতায় বাধা সৃষ্টি করে, বিশেষ করে রক্ত পাতলা করার ওষুধের সঙ্গে।
- সাজনার শিকড় এবং বাকল জরায়ুর সংকোচন ঘটাতে পারে, তাই এটি সেবনে গর্ভবতী নারীদের সতর্ক হওয়া উচিৎ।
সাজনার উপকারিতা ও অপকারিতা- শেষকথা
সাজনা অন্যতম একটি পুষ্টিকর এবং অনেক ঔষধি গুণসম্পন্ন উদ্ভিদ। তবে, এটি অধিক পরিমাণে সেবনে অপকারিতা বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া দেখা দিতে পারে। তাই, সাজনার অধিক উপকারিতা পাওয়ার জন্য সঠিক নিয়মে খাওয়াই ভালো।
আরো পড়ুনঃ মাসরুমের পুষ্টিগুণ, উপকারিতা ও পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া
প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, আমরা আশাকরি আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পেরেছি, "সাজনার পুষ্টিগুণ উপকারিতা ও অপকারিতা" সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য। যা আপনাদের অনেক উপকারে আসবে বলে আমরা আশাবাদী। সঙ্গে থাকার জন্য ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url