মরণ ফাঁদ হয়ে ওঠেছে দৈনিক কিস্তি
আরো পড়ুনঃ সঞ্চয় কি? সঞ্চয়ের উপকারিতা ও অপকারিতা
বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক বাস্তবতায় অনেক মানুষেই বিভিন্ন কিস্তির মাধ্যমে বিশেষ করে দৈনিক কিস্তির মাধ্যমে ব্যবসার মূলধন সংগ্রহ করছেন। অনেকে এই পথ বেচে নেন, সহজ শর্ত এবং দ্রুত নগদ অর্থ পাওয়ার প্রলোভনে।
কিন্তু এই সুবিধাই একসময় হয়ে ওঠে মরণ ফাঁদ, যা ধীরে ধীরে ঋণ গ্রহীতাকে আর্থিক এবং মানসিক চাপে ফেলে দেয়। আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো মরণ ফাঁদ হয়ে ওঠেছে দৈনিক কিস্তি সম্পর্কে তথ্য। চলুন তাহলে আমরা দেখে নেই-
দৈনিক কিস্তি কাকে বলে?
দৈনিক কিস্তি ব্যবস্থা সাধারণত এনজিও, খুদ্র ঋণদানকারি প্রতিষ্ঠান বা অনেক সময় ব্যক্তি পর্যায়ে পরিচালিত হয়ে থাকে। এতে ঋণ গ্রহীতা নির্দিষ্ট পরিমাণ একটি অর্থ ঋণ হিসাবে গ্রহণ করেন এবং তাকে প্রতিদিন নির্ধারিত পরিমাণের একটি অঙ্ক পরিশোধ করতে হয়।
দৈনিক কিস্তি ব্যবস্থাটি শুরুর দিকে অনেক সুবিধাজনক বলে মনে হলেও, এটি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের দুঃস্বপ্ন হয়ে উঠেছে।
দৈনিক কিস্তি কেন মরণ ফাঁদ?
ব্যবসায়ী বা দৈনিক কিস্তির ঋণগ্রহীতারা অনেকেই জানেন না, তারা কত টাকা ঋণ গ্রহণ করেছেন এবং কত টাকা সুদ দেন। একজন ঋণগ্রহীতা যখন (দাদন ব্যবসায়ী বা সুদখোর) এই ধরনের প্রতিষ্ঠানে ঋণ গ্রহণের জন্য ভর্তি হন, তখন থেকে নিম্নলিখিত তথ্যগুলি তাদের সুবিধার্থে তুলে ধরলাম:
** ভর্তির সময়- ভর্তি ফি ১০০ টাকা, সঞ্চয় ১০০ টাকা, শেয়ার ১০০ টাকা, পাশবই ও অন্যান্য খরচ ৩০ টাকা—মোট ৩১০ টাকা, যার অফেরতযোগ্য ১৩০ টাকা।
** ঋণ গ্রহণের সময়- গ্রহণকৃত ঋণের ১০%, সঞ্চয়, শেয়ার ২.৫%, ডিপিএস ১%, এবং .০৫% থেকে ১% বিমা (বীমা অফেরতযোগ্য)। অর্থাৎ, একজন ঋণগ্রহীতা যদি ১ লক্ষ টাকা ঋণ গ্রহণ করেন, তাকে জমা দিতে হবে প্রায় ১৪০০০ টাকা এবং তিনি পাবেন ৮৬ হাজার টাকা।
কিন্তু তাকে সুদ দিতে হবে ১ লক্ষ টাকার, যা হতে পারে ৮% থেকে ১০% বা কখনো কখনো ১২% পর্যন্ত। এই টাকা সুদসহ ১০০ কিস্তিতে (৪ মাস সময়) পরিশোধ করতে হবে, ঋণ গ্রহণের ১ দিন পর থেকে।
অর্থাৎ, চার মাসে ৮৬ হাজার টাকার সুদ হবে ৮ হাজার টাকা থেকে ১২ হাজার টাকা। তাহলে ৮৬ হাজার টাকার সুদ বারো মাসে দাঁড়ায় ২৪ হাজার টাকা থেকে ৩৬ হাজার টাকা। সঠিক হিসাব করলে, এটি দাঁড়ায় প্রায় ৬০% থেকে ৮০%।
** ঋণ গ্রহণের জন্য প্রয়োজনীয় নথি- যখন কোন ব্যবসায়ী বা ঋণগ্রহীতা ঋণ গ্রহণ করেন, তখন তাকে জমা দিতে হবে তার নিজের এবং দুইজন জামিনদারের ব্যাংক চেক (যা কেউ ফাঁকা চেক বা কেউ লাভসহ লিখে রাখেন লাভসহ)।
এছাড়া, জমা দিতে হবে ঋণগ্রহীতা ও জামিনদারের স্বাক্ষরকৃত ৩০০ টাকা দামের নন-জুডিশিয়াল স্টাম্প এবং জাতীয় পরিচয়পত্রসহ ঋণগ্রহীতার ব্যবসায়িক ট্রেড লাইসেন্স।
যদি কোন ব্যবসায়ী ঋণের কিস্তি দিতে ব্যর্থ হন, তাহলে লাইসেন্সধারী সুদখোর ঋণগ্রহণের সময় জমাকৃত চেক এবং নন-জুডিশিয়াল স্টাম্প দিয়ে আদালতে মামলা করে দেন। আর ব্যবসায়ীরা মামলা মাথায় নিয়ে আদালতের বারান্দায়, একসময় জেলে গিয়ে বের হয়ে আসেন।
আরো পড়ুনঃ দৈনিক কিস্তি কি? দৈনিক কিস্তির সুবিধা ও অসুবিধা
দৈনিক কিস্তির অপকারিতা
যদিও, সব জিনিসের উপকারিতা থাকে এবং অল্প পরিমাণে খারাপ দিক থাকে। কিন্তু দৈনিক কিস্তির ক্ষেত্রে উপকারিতা অল্প কিছু থাকলেও এর অনেক অপকারিতা। যেমন, একজন মানুষ ক্যান্সারে আক্রন্ত হলে বাচা অনেক কঠিন হয়, তেমনি দৈনিক কিস্তির অবস্থা। তবে, দেখি কিছু অপকারিতা-
** উচ্চ সুদের হার- দৈনিক কিস্তির সবচেয়ে বড় এবং মূল সমস্যা হলো এর সুদের হার অত্যধিক। সাধারণত এই ঋণের উপর সুদের হার যদি বার্ষিক ভিত্তিতে গণনা করা যায়, তাহলে এটি প্রচলিত ব্যাংক ঋণের তুলনায় অনেক অনেক বেশি।
সহজ সরল ব্যবসায়ী বা ঋণগ্রহীতারা অনেক সময় এই জটিল হিসাবটি বুঝতে পারেন না এবং সহজলভ্য মনে করে এই ঋণ নিয়ে থাকেন এবং পরবর্তীতে বেশিরভাগ ঋণ গ্রহীতা বিপদে পড়েন।
** অবিরাম চাপ ও মানসিক যন্ত্রণা- প্রতিদিন নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা পরিশোধ করার চাপে একজন ঋণগ্রহীতা মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েন। এছাড়া, যদি কোনো কারণে কিস্তি পরিশোধে ব্যর্থ হন, তখন দাদন ব্যবসায়ীরা নানা ধরনের চাপ প্রয়োগ করেন, যা মানসিক অশান্তি ও আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
** ব্যবসায় লোকসানের শিকার- অনেক ছোট ব্যবসায়ী পুঁজি সংগ্রহের জন্য অযথা দৈনিক কিস্তিতে ঋণ নেন। তবে, যদি ব্যবসার মুনাফা প্রত্যাশিত না হয়, তখন ঋণের কিস্তি পরিশোধ করা তাদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে।
ফলে তারা এক ঋণ পরিশোধ করতে নতুন ঋণ নিয়ে পুরোনো ঋণ শোধ করতে বাধ্য হন, যা এক সময় তাদেরকে দেউলিয়াত্বের দিকে ঠেলে দেয়।
** ঋণের ফাঁদে আটকে পড়া- প্রথম দিকে কিস্তি পরিশোধ করা সম্ভব হলেও সময়ের সাথে সাথে এটি আরও কঠিন হয়ে ওঠে। অনেকেই এই ঋণ পরিশোধ করতে নতুন ঋণ নিয়ে থাকেন, যার ফলে তারা চক্রবৃদ্ধি সুদের জালে আটকে পড়েন।
এতে তারা ঋণমুক্ত হতে পারেন না, বরং ক্রমাগত নতুন ঋণের বোঝা বাড়তে থাকে। একসময় তারা ঋণের টাকা দিতে না পেরে ব্যবসা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন।
কিভাবে এই ফাঁদ থেকে মুক্ত থাকা যায়?
** সচেতনতা বৃদ্ধি- দৈনিক কিস্তির প্রকৃত চিত্র সম্পর্কে ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সকল মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করা দরকার। ঋণ নেওয়ার আগে সুদের হার ও পরিশোধের সক্ষমতা সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা থাকতে হবে।
** পরিকল্পিত আর্থিক ব্যবস্থাপনা- শুধু দৈনিক কিস্তি নয়, যে কোনো ঋণ নেওয়ার আগে সেই ঋণ পুনঃপরিশোধের পরিকল্পনা থাকা জরুরি। আয়-ব্যয়ের হিসাব না করে ঋণ নেওয়া ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে।
** ব্যাংক ও বৈধ ঋণ প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ গ্রহণ- যদি ঋণের প্রয়োজন হয়, তবে সুদের হার ও শর্ত যাচাই করে বৈধ আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নেওয়া উত্তম। ব্যাংক ও সরকারি ঋণ সহায়তা প্রকল্পগুলো তুলনামূলক কম সুদে ঋণ প্রদান করে।
** আয় বৃদ্ধি ও বিকল্প উপার্জন- দৈনিক কিস্তির বোঝা কমাতে আয় বৃদ্ধির পথ খোঁজা জরুরি। এক্ষেত্রে পার্ট-টাইম কাজ, ফ্রিল্যান্সিং বা ক্ষুদ্র ব্যবসা করে অতিরিক্ত আয় করার চেষ্টা করা যেতে পারে।
দৈনিক কিস্তি- শেষকথা
দৈনিক কিস্তির প্রলোভনে পড়ে বর্তমানে অনেক মানুষ নিজেদের আর্থিক সংকটকে আরো গভীর করে তুলছেন। এটি আসলে সহজ কোন ঋণ নয়, বরং এটি একটি আর্থিক ফাঁদ, যা ব্যবসায়ীদের ঠেলে দেয় দেউলিয়াত্বের দিকে।
তাই যে কোন ধরণের ঋণ নেওয়ার আগে ভালোভাবে চিন্তা করা এবং ঋণ ছাড়া বিকল্প পথ খোঁজ করা প্রয়োজন। একমাত্র সচেতনতা ও সঠিক পরিকল্পনার মাধ্যমে এই মরণ ফাঁদ থেকে নিজেদের রক্ষা করা সম্ভব।
প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ, আমরা আশাকরি আপনারা যদি আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলটি মনোযোগের সঙ্গে পড়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন, "মরণ ফাঁদ হয়ে ওঠেছে দৈনিক কিস্তি" সম্পর্কে অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য।
আরো পড়ুনঃ ঢাকা থেকে কোন জেলার দূরত্ব কত? | কোন জেলার বিখ্যাত খাবার কি?
আশাকরি আর্টিকেলটি আপনাদের অনেক উপকারে আসবে। আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে এবং উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করবেন। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন, ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url