আরো পড়ুনঃ নওগাঁর দর্শনীয় স্থান পাহাড়পুর বৌদ্ধ বিহার
দিনাজপুর জলা বাংলাদেশের উত্তরের বিভাগ রংপুরের প্রশাসনিক এটি এলাকা। এই জেলার সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে প্রাচীন ঐতিহ্যের নানান স্মৃতি।
দিনাজপুর জেলার রয়েছে ঐতিহ্যবাহী বিভিন্ন খাবার, বিখ্যাত খাবারসহ বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান এবং দেশের সবচেয়ে বেশি লিচু ও চিকন চাল উতপাদনের কারণে দিনাজপুর সারা বাংলাদেশে পরিচিত।
আর আপনি যদি বাংলাদেশের বিশেষ করে উত্তর বঙ্গের কিংবা দিনাজপুরে বসবাস করে থাকেন, তাহলে আপনি জানবেন না, দিনাজপুর কিসের জন্য বিখ্যাত এটা কখোনই হতে পারেনা। তাই আজকের আর্টিকেলে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো "দিনাজপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত'' সহ দিনাজপুর সম্পর্কে অজানা অনেক তথ্য। চলুন তাহলে দেখে নেওয়া যাক-
দিনাজপুরের ভৌগলিক অবস্থান
দিনাজপুর জেলার ভউগলিক অবস্থান ২৪ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশ এবং ২৫.৩৬ ডিগ্রী উত্তর অক্ষাংশ এবং ৮৮ ডিগ্রী পূর্ব দ্রাঘিমাংশ ও ৮৯ পূর্ব দ্রাঘিমাংশের মধ্যে। এই জেলার মোট আয়তন ৩৪৩৭.৫৮ বর্গ কলোমিটার।
এই জেলার উত্তরে রয়েছে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও এবং নীলফামারী জেলা, দক্ষিণে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং রাজশাহী বিভাগের জয়পুরহাট জেলা, পূর্ব দিকে রয়েছে বিভাগীয় জেলা রংপুর এবং নীলফামারী জেলা এবং পশ্চিম দিকে রয়েছে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ।
দিনাজপুর জেলার জনসংখ্যার তথ্য
৩৪৩৭.৫৮ বর্গ কলোমিটার আয়তনের দিনাজপুর জেলার জনসংখ্যা ২০২২ সালের আদম শুমারি অনুযায়ী সর্বমোট ৩৩,১৫,২৬৮ জন। যার মধ্যে পুরুষ ১৬,৬০,৯৯৭ জন এবং মহিলা ১৬,৫৪,২৪১ জন। এই জেলার জনসংখ্যার ঘনন্ত ৯৬৩ জন। আর এই জনসংখ্যার প্রায় ২০% শহরে এবং প্রায় ৮০% লোক গ্রামে বসবাস করেন।
দিনাজপুর নাম করণের ইতিহাস
১৭৮৬ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রাচীন এই দিনাজপুর জেলা। লোকশ্রুতি রয়েছে এক সময় বৃহত্তর দিনাজপুর এলাকা প্রতিষ্ঠিত করেন জনৈক দিনরাজ বা দিনাজ নামের একটি রাজ পরিবার। আর তার নাম অনুসারে যেখানে রাজবাড়ীটি অবস্থিত, সেই মৌজার নাম হয় দিনাজপুর। পরবর্তী সময়ে তৎকালীন ব্রিটিশ শাসকেরা বাতিল করেন ঘোড়াঘাট সরকার এবং গঠন করেন জেলা এবং দিনরাজ রাজার সম্মানে জেলার নাম করণ করা হয় দিনাজপুর।
দিনাজপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত
দিনাজপুর জেলাকে তার বিখ্যাত খাবার, মিষ্টি এবং বিখ্যাত ব্যক্তিদের জন্য এক সময় বিখ্যাত ছিল। তবে, সময়ের আবর্তে এখানে জনপ্রিয় হয়ে উঠে চাষাবাদ। সেই ধারাবাহিকতায় দিনাজপুরের বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয় লিচু চাষ এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে লিচু হয়ে উঠে দিনাজপুরের বিখ্যাত। তাছাড়া বর্তমানে চিড়া এবং কাটারিভোগ চালেও বিখ্যাত হয়ে উঠে দিনাজপুর। মূলত লিচুর জন্য বিখ্যাত দিনাজপুর জেলা। নিম্নের আলোচনার মাধ্যমে জেনে নেওয়া যাক দিনাজপুরের বিখ্যাত সম্পর্কে-
দিনাজপুর জেলার বিখ্যাত খাবার
দিনাজপুর জেলার খাবার তার নিজস্ব স্বাদের জন্য সারা বাংলাদেশে বেশ বিখ্যাত। আর বিখ্যাত খাবার গুলোর মধ্যে রয়েছে-
প্যালকা- প্যালকা হলো দিনাজপুররের ঐতিহ্যবাহী খাবার, এই খাবারটি সাধারণত গ্রামাঞ্চলে সবচেয়ে বেশি রান্না করা হয়ে থাকে। আর এই খাবার রান্না করা হয় বিভিন্ন শাক দিয়ে এবং পরিবেশন করা হয় ভাত এবং রুটি- পরাটার সঙ্গে।
সিদল- সিদল হলো দিনাজপুররের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী খাবার, যা দিনাজপুরের একান্ত নিজস্ব খাবার। সিদল তৈরির মূল উপাদান হলো ভেড়ার মাংস, মরিচ, পেয়াজ, ধনেপাতা, জিরা ও গরম মসল্লা। এটি পরিবেশন করা হয় ভাত এবং রুটি- পরাটার সঙ্গে।
সিদল ভর্তা- সিদল ভর্তা হলো, সিদল দিয়ে তৈরি করা একটি ভর্তা, যা দিনাজপুর জেলার জনপ্রিয় ভর্তা। সিদল দিয়ে তৈরি করা হয় মরিচ, পেয়াজ, ধনেপাতা, জিরা ও গরম মসল্লা। এটি পরিবেশন করা হয় ভাত এবং রুটি- পরাটার সঙ্গে।
বুট বিরিয়ানি- বুট বিরিয়ানি দিনাজপুরের অন্যতম প্রধান জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী খাবার। এটি তৈরির মূল উপাদান ভেড়ার মাংস, মরিচ, পেয়াজ, ধনেপাতা, জিরা ও গরম মসল্লা। এটি পরিবেশন করা হয় ভাত এবং রুটি- পরাটার সঙ্গে।
মহাজনি মিষ্টি পোলাও- এই ঐতিহ্যবাহী খাবারটি সাধারণত ধণী বা মহাজন সম্প্রাদয়ের লোকেরা খেয়ে থাকেন। মহাজনী মিষ্টি পোলাও তৈরির মূল উপাদান হলো ভেড়ার মাংস, মরিচ, পেয়াজ, এলাচ, জায়ফল, জয়ত্রী, চিনি, দারুচিনি, ধনেপাতা, জিরা ও গরম মসল্লা ইত্যাদি। এটি পরিবেশন করা হয় ভাত এবং রুটি- পরাটার সঙ্গে।
পাপড়- দিনাজপুরের পাপড়, দিনাজপুর তথা সারা বাংলাদেশের মানুষের কাছে অনেক জনপ্রিয়। এই পাপড় বিশেষ এক পদ্ধতিতে তৈরি করেন দিনাজপুরের মানুষ। দিনাজপুরের পাপড়ের স্বাদ অন্য যে কোন পাপড়ের থেকে অন্য রকম।
দিনাজপুরের বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান
দিনাজপুর জেলা বাংলাদেশের অন্যতম একটি প্রাচীন এবং সমৃদ্ধশালী একটি জেলা। এই জেলার গর্বিত ইতিহাস, সমৃদ্ধ জনপদ এবং নিজস্ব সংস্কৃতির জন্য বাংলাদেশে বেশ বিখ্যাত। প্রাচীন জনপদের জেলা দিনাজপুরে রয়েছে বেশ কিছু বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান। এর মধ্যে কয়েকটির তালিকা নিম্নে আলোচনা করা হলো-
হযরত শাহ্ মখদুম রুপোশের মাজার- দিনাজপুর শহরের প্রাণ কেন্দ্রে এই মাজারটি অবস্থিত। দিনাজপুরের অন্যতম জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হলো হযরত শাহ্ মখদুম রুপোশের মাজার। হযরত শাহ্ মখদুম রুপোশ ছিলেন একজন বিখ্যাত সুফি সাধক। তিনি দিনাজপুরে এসেছিলেন ১৪ শতাব্দির দিকে।
হযরত শাহ্ সুলতান আহমেদ খানের মাজার- দিনাজপুর শহরের প্রাণ কেন্দ্রে এই মাজারটি অবস্থিত। দিনাজপুরের অন্যতম জনপ্রিয় এবং বিখ্যাত দর্শনীয় স্থান হলো হযরত শাহ্ সুলতান আহমেদ এর মাজার। তিনি ১৫ শতাব্দির দিকে দিনাজপুর আসেন এবং তিনা ছিলেন হযরত শাহ্ মখদুম রুপোশের শিস্য। তিনি দিনাজপুরে মৃত্যু বরন করেন।
শিশু পার্ক- দিনাজপুর শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত শিশু পার্কটি দিনাজপুরের অন্যতম জনিপ্রিয় একটি বিনোদন কেন্দ্র। এই বিনোদন পার্কে শিশুদের জন্য বিভিন্ন সরঞ্জাম রয়েছে।
কান্তজিউ মন্দির- দিনাজপুর জেলা শহর থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে দিনাজপুর- তেতুলিয়া মহাসড়কের পশ্চিম পার্শ্বে ঢেপা নদীর তীরে অবস্থিত। এই মন্দিরটি বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় স্থাপনা এবং বাংলাদেশের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন। এই ঐতিহাসিক স্থাপনাটি ১৭০৪ খ্রীস্টাব্দে নির্মাণ করেন মহারাজা প্রাণ্নাথ।
রামসাগর- দিনাজপুরের অন্যতম প্রধান এবং বিখ্যাত স্থান হলো রামসাগর। এটি মুলত একটি কৃত্রিম দীঘি যা রাজা রামনাথ পলাশী বিপ্লবের অল্পদিন পূর্বে প্রজাদের পানির কস্ট লাঘবের জন্য খনন করন। এর আয়তন প্রায় ৪৩৭.৪৯২ বরগমিটার।
গোর- এ শহীদ- দিনাজপুরের বাংলাদেশের অন্যতম ঐতিহাসিক স্থান হলো গোর এ শহীদ। এই স্থানে ১৮৫৭ সালে সংঘঠিত সিপাহী বিদ্রোহে শহীদ হওয়া শহীদদের সমাধি স্থল এটি।
মহারাজা দীঘি- প্রায় ৩০০০ বর্গ মিটার আয়তনের এই দীঘিটি ১৯শ শতাব্দিতে খনন করা হয়েছিল। এই দীঘিটি দিনাজপুরের অন্যতম একটি ঐতিহাসিক স্থান। এছাড়াও দিনাজপুরে রয়েছে-
- সূরা মসজিদ।
- দরিয়া মসজিদ।
- নয়াবাদ মসজিদ।
- অরুন ধাপ।
- ঘোড়াঘাট দুর্গ।
- বার পাইকের গড়।
- সীতা কো্ট বিহার।
- চোর চক্রবর্তী ঢিপি।
- ভাঙ্গা দীঘি।
- সাগর দীঘি।
- রাম সাগর মন্দির।
- গোপালগঞ্জ মন্দির।
- কাহারোল প্রাচীন বিষ্ণু মন্দির।
- খানসামা জমিদারবাড়ী।
- ঘুঘুডাঙ্গা জমিদারবাড়ী।
- দিনাজপুর জমিদারবাড়ী।
- রখুনী কান্ত জমিদারবাড়ী।
- দিনাজপুর জাদুঘর।
- বীরগঞ্জ জাতীয় উদ্যান।
- নবাবগঞ্জ জাতীয় উদ্যান।
- রামসাগর জাতীয় উদ্যান।
- স্বপ্নপুরি বিনোদন পার্ক।
- গোর-এ- শহীদ ঈদ্গাহ মজাদুঘ।
দিনাজপুর জেলার বিখ্যাত ব্যক্তির নাম
প্রাচীন দিনাজপুরে রয়েছে অনেক বিখ্যাত ব্যক্তি। নিম্নে তাদের কয়েক জনের নামের তালিকা দেখানো হলো-
- বাংলাদেশের প্রথম মহিলা প্রধান মন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া।
- ব্রিটশ ভারতের এমপি জনাব শামসুদ্দিন আহম্মেদ।
- জ্যেষ্ঠ অ্যাডভোকেট এম আব্দুর রহমান।
- শিক্ষাবিদ এটিএম আফজাল।
- অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
- হাজী মোহাম্মদ দানেশ।
- সংসদ সুভাষ দত্ত।
- বিমান ঘোষ।
- লিটন দাস।
দিনাজপুর জেলার বিখ্যাত- শেষকথা
প্রিয় পাঠক পাঠিকাগণ আমরা আশাকরি, আপনারা যদি আজকের এই গুরুত্বপূর্ণ আর্টিকেলটি শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত মনোযোগের সঙ্গে পুরোটাই পড়ে থাকেন, তাহলে নিশ্চয়ই জেনে গেছেন "দিনাজপুর জেলা কিসের জন্য বিখ্যাত" সেই সম্পর্কে অনেক তথ্য। যা আমরা আর্টিকেলের মধ্যে আপনাদের সঙ্গে আলোচনা করেছি।
যা আপনাদের অনেক উপকারে আসবে বলে আমরা অনেক আশাবাদী, বিশেষ করে যারা প্রাচীন দিনাজপুর সম্পর্কে জানতে ইচ্ছুক, তাদের ক্ষেত্রে। আর্টিকেলটি যদি আপনাদের ভালোলাগে ও উপকারি বলে মনে হয়, তাহলে এটি অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে ভূলবেন না। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের পরবর্তী আর্টিকেল পড়ুন এবং আমাদের সঙ্গে থাকুন। ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url