ধবংপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার দিনাজপুর
আরো পড়ুনঃ দেশের সবচেয়ে বড় নবরত্ন মন্দির সিরাজগঞ্জ
বাংলাদেশ উত্তর থেকে দক্ষিণ, পূর্ব থেকে পশ্চিম সব স্থানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে জানা অজানা হাজার হাজার পুরাকীর্তি। যার কিছু মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে রয়েছে আবার কোথাও প্রকৃতির সঙ্গে জুদ্ধ করে টিকে থাকতে না পেরে কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে আবার কোথাও কোথাও অবহেলা আর অযত্নে ধবংসের দ্বার প্রান্তে এসে কোন রকমে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত যে ২৫০০টি স্থাপনা রয়েছে তাঁর অন্যতম দিনাজপুর জেলার আওতাধীন নবাবগঞ্জ উপজেলায় অবস্থিত সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার। আজকের আর্টিকেলে আমরা আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করবো ''ধবংপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার দিনাজপুর'' সম্পর্কে সকল তথ্য। চলুন দেখে নেওয়া যাক-
আজকের পাঠ্যক্রম- ধবংপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার দিনাজপুর
- ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার কোথায় অবস্থিত
- ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের নাম করণ
- ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস
- ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের নির্মাণশৈলী
- বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের নাম ও অবস্থান
- ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারে উদ্ধার করা প্রত্নসামগ্রী
- ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের শেষকথা
ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার কোথায় অবস্থিত
দিনাজপুর জেলার নবাবগঞ্জ উপজেলা সদর হতে মাত্র দুই কিলোমিটার দূরে বিরামপুরগামী মহাসড়ক সংলগ্ন (রাস্তার উত্তর পার্শ্বে) ফতেপুর গ্রামে ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারটি অবস্থিত। এই বিহারটির আয়তন প্রায় এক একর।
ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের নাম করণ
লোকশ্রুতি আছে যে, এখানে দীর্ঘদিন যাবত রামের স্ত্রী শীতা বসবাস করেছিলেন। আর তাঁর নাম অনুসারে এই স্থানটির নাম সীতাকোট। আবার অনেকে এই স্থানটিকে সীতা কুঠুরী বলে থাকেন। মূলত এটি একটি বৌদ্ধ বিহার হলেও সকলের কাছে সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার নামে সর্বাধিক পরিচিত।
ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের ইতিহাস
জনাব আবুল কালাম মোহাম্মাদ যাকারিয়ার উদ্যোগে ১৯৬৮ সালে জেলা পরিষদের অর্থয়ানে এবং বাংলাদেশ প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তরের কারিগরি সহায়তায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন করার মাধ্যমে সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারটি আবিষ্কৃত হয়েছিল। ঐতিহাসিক এই বিহারটি আবিস্কারের সময় কোন শীলালিপি না পাওয়ার কারণে এর নির্মাণ সময় এবং নির্মাতার নাম পাওয়া যায়নি।
তাছাড়া এই বিহারের স্তরবিন্যাস পদ্ধতিতে বিহারটির নির্মাণ সময় নির্ধারণ করা ছিল না। তবে ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারটি যে খ্রিষ্টীয় পঞ্চম শতক থেকে ষষ্ঠ শতকের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছিল তার অনেক প্রমাণ পাওয়া গিয়েছে। পরবর্তী সময় ১৯৭২- ১৯৭৩ সালে পুনারায় এই বিহারটিতে খনন কাজ চালানো হয়েছিল।
ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের নির্মাণশৈলী
ঐতিহাসিক এই স্থাপনাটির পূর্ব ও পশ্চিম বাহু ৬৫.২৩ মিটার এবং উত্তর ও দক্ষিণ বাহু ৬৪.১১ মিটার। প্রায় বর্গাকার বিহারটির বহির্দিক প্রক্ষিপ্ত ছিল উত্তর ও দক্ষিণের বাহুদ্বয়। প্রশস্ত মুখপাত বিশিষ্ট তোরণ ভবন কমপ্লেক্সটি অবস্থিত ছিল উত্তর বাহুর মধ্যাংশে। পূর্ব বাহুর উত্তরাংশে একটি সম্পূরক প্রবেশ পথ ছিল যা পেছনের দেয়াল ভেদ করে আছে।
ভবনটির উত্তর বাহুতে আটটি এবং বাকী তিন বাহুতে এগারোটি করে তেত্রিশটিসহ সরবমোট একচল্লিশটি কক্ষ ছিল। এর সকল কক্ষগুলি সমায়তনের, যার দীর্ঘ ৩.৬৬ মিটার এবং প্রস্থ ৩.৩৫ মিটার। দেওয়ালে কুলুঙ্গি ছিলো কক্ষগুলির পেছনে এবং দেওয়াল দ্বারা কক্ষগুলি বিভক্ত করা ছিলো। কক্ষের বিভাজন করা দেওয়াল ০.৯১ মিটার থেকে ১.২২ মিটার পুরুত্ব ছিলো।
আরো পড়ুনঃ প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘর ঐতিহাসিক পাহাড়পুর নওগাঁ
আর সামনের দেওয়াল ২.৫৯ মিটার এবং পিছনের দেওয়াল ১.০৭ মিটার পুরুত্ব ছিলো। ভবনের ভিতরে ২.৫৯ মিটার প্রশস্ত একটি টানা বারান্দা ছিলো। বারান্দার সঙ্গে সংযুক্ত থাকা কক্ষগুলোতে প্রবেশ করার জন্য লম্বা ১.৬৮ মিটার এবং প্রশস্ত ১.০৭ মিটার দরজা ছিলো। বারান্দাকে আঙ্গিনা থেকে আড়াল করার জন্য ০.৭৬ মিটার উচ্চতা এবং ১.২২ পুরু দেওয়াল ছিলো।
বিহারের দক্ষিণ, পূর্ব এবং পশ্চিমের বাহুতে থাকা মূল কক্ষগুলি অন্য সাধারণ কক্ষের তুলনায় আয়তনের দিক থেকে কিছুটা বড় ছিলো। পূজার মূর্তি রাখার জন্য সকল মূল কক্ষে ইটের তৈরী একটি করে বেদী ছিলো। বিহারে থাকা প্রধান মন্দিরের সম্মুখে মন্ডপ হিসাবে স্তম্ভ শোভিত প্যাভিলিয়নটিকে ব্যবহার করা হত।
বিহার থেকে একটু দূরে দক্ষিণ দিকে প্রধান ভবনের সঙ্গে সংযুক্ত সম্মুখভাগে আবৃত পথ দিয়ে গিয়ে পাওয়া যায় বারান্দাসহ পাঁচটি কক্ষ। এটি দেখ ধারণা করা হয়ে থাকে এগুলি নির্মাণ করা হয়েছিলো সম্ভাবত শৌচাগার হিসাবে। এই বিহারটি নির্মাণ এবং ছাদ ঢালাইয়ের জন্য ইট, চুন, সুরকি এবং ছাদের ভার বহনের জন্য ব্যবহার করা হয়েছিলো কড়িকাঠ।
সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের আঙ্গিনার মাঝ বরাবর নির্মাণ করা হয়েছিল প্রধান মন্দির। তবে এই বিহারে অন্য সকল বিহারের মতো (পাহাড়পুর বিহার, আনন্দ বিহার কিংবা শালবন বিহার) অনুপস্থিত দেখা যায় ঐতিহ্যবাহী পোড়ামাটির ফলক। কিন্তু আকার এবং আয়তনের দিক থেকে অনেকটাই মিল রয়েছে সীতাকোট বিহার এবং বগুড়ার ভাসু বিহারের সঙ্গে।
বাংলাদেশের প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের নাম ও অবস্থান
বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে থাকা প্রাচীন বৌদ্ধ বিহারের নাম ও অবস্থানের তালিকা নিম্নে দেখানো হলো-
প্রাচীন বিহারের নাম বিহারের অবস্থান
- আনন্দ বিহার লালমাই, ময়নামতি, কুমিল্লা।
- গোকুল বিহার মহাস্থানগড়, বগুড়া।
- চাপড়াকোট বিহার বদরগঞ্জ, রংপুর।
- জগদ্দল বিহার ধামইরহাট, নওগাঁ।
- পাহাড়পুর বিহার বদলগাছি, নওগাঁ।
- ভাসু বিহার শিবগঞ্জ, বগুড়া।
- ভোজ বিহার কোটবাড়ি, কুমিল্লা।
- মহামুণি বিহার রাউজান, চট্টগ্রাম।
- রাজবন বিহার রাঙ্গামাটি।
- শালবন বিহার ময়নামতি, কুমিল্লা।
- সীতাকোট বিহার নবাবগঞ্জ, দিনাজপুর,
- সীমা বৌদ্ধ বিহার পটুয়াখালি।
- হলুদ বিহার বদলগাছি, নওগাঁ।
ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারে উদ্ধার করা প্রত্নসামগ্রী
ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার খননকালে প্রাপ্ত মহামূল্যবান এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রত্ন নিদর্শন হলো ব্রোঞ্জ দ্বারা নির্মিত একটি বোধিসত্ত্ব পদ্মাপাণি এবং ব্রোঞ্জ দ্বারা নির্মিত একটি বোধিসত্ত্ব মঞ্জুশ্রী মূর্তি। উক্ত মূর্তি দুটির গঠনশৈলী দেখে ধারণা করা হয় যে, এই মূর্তিগুলো সপ্তম শতাব্দী থেকে অষ্টম শতাব্দীতে তৈরী করা হয়। এই বিহারে প্রাপ্ত প্রায় সকল সামগ্রী দিনাজপুর মিউজিয়ামে রয়েছে।
ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের শেষকথা
ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহারের মতো শত শত ঐতিহাসিক নিদর্শন বর্তমানে বাংলাদেশের আনাচে কানাচে অযত্ন এবং অবহেলার কারণে হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই আমাদের সকলের উচিৎ কর্তৃপক্ষের পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে এগুলোর যত্ন নেওয়া। আশাকরি আমরা আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আপনাদের সঙ্গে শেয়ার করতে পেরেছি "ধবংপ্রাপ্ত ঐতিহাসিক সীতাকোট বৌদ্ধ বিহার দিনাজপুর" সম্পর্কে সকল তথ্য।
আরো পড়ুনঃ মুর্শিদ জামাই পাগলের মাজার
যা আপনাদের অনেক উপকারে আসবে বলে আমরা আসাবাদি। বিশেষ করে যারা এই ঐতিহাসিক নিদর্শন সম্পর্কে জানতে আগ্রহী তাঁদের ক্ষেত্রে। আর্টিকেলটি যদি ভালোলাগে ও উপকারি বলে কনে হয়, তবে এটি অবশ্যই অন্যের সঙ্গে শেয়ার করতে ভূলবেন না। আরো নতুন নতুন তথ্য জানার জন্য আমাদের সঙ্গে থাকুন। ধন্যবাদ।
এই ওয়েবসাইটের নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url